১। নবেবছ পাগলের চাঁদ শহরঃ
নাম ছিল তার নওয়াজেশ আলী কিন্তু পরিচিতি ছিল নবেবছ পাগল বলে। বাসাইল উপজেলার কাউলজানী ইউনিয়নের বার্থা গ্রামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক কালে অর্থাৎ ১৯১০- ১৯১৫ সনের মধ্যে তাঁর জন্ম। পিতা ছিলেন একজন নিরীহ কৃষক। নবেবছ ছিল তার একমাত্র সন্তান। ভালই বেড়ে উঠে নওয়াজেশ আলী। কিন্তু ছোটকাল থেকেই সে ছিল একটু ভিন্নরকমের। চুপ-চাপ থাকত দীর্ঘ সময়। আশে পাশের লোকজনকেও যেন চিনত না। এমন ভাবে শৈশব পার করে কৈশোরে পা’দেয় নবেবছ। কিন্তু এ সময়ে তার আচরণে ভিন্নতা দেখা যায়। লোকজনকে যেন সইতে পারতো না সে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো। আবার আপন মনে কথা বলতো কখনো কখনো। লোকে বলত মাথায় বায়ু চড়ে মাসের ১৫ দিন পাগলামীর ধাতে থাকে। বাকী সময় আবার সুস্থ্য থাকে। সংসারের বোঝা মাথায়। কৃষক বৃদ্ধ হয়েছে। সামান্য জমি, যা ধান হয় তাতে সংসার চলে না। বিয়ে করেনি নবেবছ। কিন্তু দায়িত্ব বোধও যেন নষ্ট হয়নি তার। প্রথম দিকে বিভিন্ন হাটে গেঞ্জী বিক্রী করতো ঘোড়ায় চড়ে। এক সময় গেঞ্জীর ব্যবসায় পুঁজি নষ্ট হয়ে যায়। এবার আর ব্যবসা নয়। ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায় সারা দিন। যখন বায়ু চড়ে যায় তখন সে নেংটা পাগল। বাসাইল-করটিয়া বাজারেই ছিল তার মূল আনাগোনা। লোকজনও এড়িয়ে চলতো তাকে, হঠাৎ করে কারো কারো কাছে জরিমানা চেয়ে বসতো সে। না চাইতেও কেউ কেউ টাকা দিতে চাইতো তাকে কিন্তু সে গ্রহণ করতো না। চকলেট খেতো মাঝে মাঝে। কখনো কখনো গায়ে চড়াত লাল সালু। বকা দিত সামনে যাকে পেতো তাকে। শক্ত মনের কেউ যদি তার পরেও থেকে যেতো, তার সাথে কথা বলতো পাগল নবেবছ। তখন বুঝবার উপায় ছিল না যে, নবেবছ একজন পাগল। ক্ষাণিক পরেই স্বস্তি ফিরে পেত সে। আবার শুরু করতো বকা, তারপর হাঁটা দিত একদিকে। লোকজন বলত, নবেবছ পাগলের বেশে এক সাধক, সে নিজেকে গোপন রাখতে চাইতো। তাই লোকজন যখন সাধক নবেবছকে আবিস্কার করতো তখনই সে বকা দিয়ে আড়াল করতো নিজেকে।
বাসাইল বাজারের পানের দোকানী ছিল আলতাফ মিয়া। সংসারে অর্থকষ্ট। বহু ত্যাগে আর ধৈর্য্যে ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে মনস্থির করে। সে নবেবছ এর সুহৃদ। একদিন বলেই ফেলে ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর কথা। ঝিম মেরে থাকে পাগল। এক সময় ,বলে, এ বছর তোর ছেলে বিদেশ যাবে না, যাবে আগামী বছর। আশ্চর্য ! বহু চেষ্টা করেও আলতাফের ছেলেকে বিদেশ পাঠানো গেল না। বছর পার হলো, নতুন বছরের শুরুতেই বিদেশ গেল আলতাফের ছেলে। ঘটনা জানাজানি হলে পাগলের প্রতি আগ্রহ বাড়ে মানুষের, বাসাইল তখন একটি গ্রাম মাত্র। বর্তমানে যেখান দিয়ে বাসাইল- টাঙ্গাইল সড়ক, সেখান দিয়ে ছিল খরস্রোতা খাল। আশে পাশে ছিল দু’একটা বাড়ী। পাশে সব নীচু জলা। বাসাইল বাজারের অস্তিত্ব তখন নেই। লোকজন শুকনা দিনে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে আর বর্ষার দিনে নৌকায় চলাফেরা করে। মূল বাজার তখন করটিয়া। বাসাইলের তখন পত্তন হচ্ছে বা হয়নি এমন সময়কার ঘটনা। নবেবছ পাগলার মাথা যখন ঠিক থাকতো তখন বলতো, এই যে নদী, এই যে জলা এসব কিছুই থাকবে না এখানে। সে চোখ বুঝলেই এখানে সেখানে দেখতে পেতো ইটের ভবন, পাকা রাস্তা, বিজলী বাতি। বলতো সবাইকে, এ রকম থাকবে না বাসাইল। বাসাইল হবে চাঁদ শহর। গাড়ী চলবে, বাতি জলবে, উচু ভবনে আর দালানে ছেয়ে যাবে সারা এলাকা।
আজ এতো বছর পরে যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে নবেবছ পাগলার ভবিষ্যৎ বাণী। অনেকেই দোয়া চাইতো কিন্তু সহজে স্বীকার করতো না সে। যারটা স্বীকার করতো মঙ্গল হতো তার, এমন জনশ্রুতি রয়েছে এলাকায়। বাসাইল এখন শহর হয়েছে। গাড়ী- বাতি- ভবনে ছেয়ে গেছে পুরো বাসাইল কিন্তু আজ নবেবছ পাগল নেই। ১৯৯৩ সনে বার্থাতেই রোগে ভূগে মারা যায় পাগল। সেখানেই সমাহিত করা হয় তাঁকে। তাঁর কবরের উপর এখন মাজার হয়েছে। মাঘ মাসে সেখানে ওরশ হয়। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় । বাসাইল, কলিয়া, কাউলজানী রাস্তা হয়ে ডানদিকে বার্থা গ্রাম। শ্রদ্ধাভরে ভক্তরা স্মরণ করে নবেবছ পাগলাকে, আর যারা শুনেছিল তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী তারা অবাক বিস্ময়ে দেখে পাকা সড়ক- গাড়ী- বিজলী বাতি ভরা চাঁদ শহর বাসাইলকে। বাসাইলের সমৃদ্ধি যেন স্মরণ করিয়ে দেয় নবেবছ পাগলের ভবিষ্যৎ বাণীকে।
২।
১২। ফাইলা পাগলাঃ
বাসাইল সখিপুর সীমান্তে সখিপুরের দাড়িয়াপুরে বসে ফাইলা পাগলার মেলা, হাজার হাজার নর-নারী, শিশু কিশোরের পদশব্দে মুখরিত হয় সে মেলা। গ্রাম্য-মুর্শিদী, মারফতী গানে ভক্ত-অভক্তরা ডুবে যায় ভাব সাগরে। পাশেই ফাইলা পাগলের মাজার, এই মাজার ঘিরেই ভক্তদের এত উৎসাহ উদ্দীপনা। অথচ কে এই ফাইলা পাগলা ? বাসাইল উপজেলায় কাশীল ইউনিয়নের দেউলী গ্রামে সম্ভ্রান্ত খন্দকার বংশে জন্ম এই ফাইলা পাগলার। শৈশব থেকেই ক্ষ্যাপাটে স্বভাব তার। ডাক নাম ছিল ফাইলা। আর ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের জন্য ডাকত ফাইলা পাগলা বলে। পরবর্তীতে এ নামের আড়ালেই হারিয়ে যায় মূল নাম। গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি। বেশীর ভাগ সময়েই থাকতো নেংটি পরা, শীতে- গ্রীস্মে একই অবস্থা। একটা ছেঁড়া কাঁথা তোলা থাকতো কাঁধে। বেশীর ভাগ সময় মেজাজ থাকতো তিরিক্ষি। ভাল থাকলে গৃহস্থালী কাজেও হাত লাগাতো । হাটে- মাঠে ঘুরে বেড়াত । উচ্চতা দেখে দুর থেকেই চেনা যেত পাগলাকে। শীত গ্রীস্ম সব সময়ই সে খেতো পান্তা ভাত। ভাত কমবেশী হোক সমস্যা নেই। গামলা ভর্তি পানি না হলে ক্ষেপে যেতো, এজন্য একবার বউ পিটিয়ে বাড়ী ছেড়েছিল সে।
মাঝে মাঝে পাগলা বনে-বাদাড়ে লাকড়ি কুড়ায়। ছোট ছোট আঁটি বাঁধে। প্রতি আঁটির দাম ধরে চার আনা। তার বেশীও নয়, কমও নয়। চার আনাই দিতে হবে। লাকড়ি বিক্রির পয়সা দিয়ে কিনত চাল-ডাল-তেল নুন সহ নানাবিধ তরকারী। তারপর বিচিত্র পদ্ধতিতে রান্না। সব তরিতরকারি চাল ডাল এক হাঁড়িতে চাপিয়ে দিতো। তারপর তৃপ্তি সহকারে ভোজন। যেদিন রান্না করত সেদিন এই নিয়ম। অন্য সময় বাড়ী বাড়ী ভাত চেয়ে খেত। কতগুলো বিরক্তিকর অভ্যাস ছিল তার। কথায় কথায় মানুষের গায়ে থুথু ছিটাতো। ঘরের চালে, নৌকার ছৈয়ায়, নয়তো মাস্ত্তলের আগায় উঠে গান গাইতো সে। অকারণে মানুষকে মারতে যেত। আর অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ ছিল সার্বক্ষণিক অভ্যাস। শুনা যায় একাধিক বউ ছিল তার। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিয়েটি টিকেনি। প্রথমটি ছিল করাতি পাড়ায় এবং দ্বিতীয়টি ছিল দাপনাজোড়ে। তবে কালিহাতীর তৃতীয় বিয়েটি টিকেছিল অনেকদিন। এই স্ত্রী হইলা বেগম সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল পাগলা। তারপর বাড়ী ছেড়েছিল সে, আর ফিরেনি। এক সময় তাকে দেখা যায় দাড়িয়াপুরের পাহাড়ে। এখানে সেখানে হাত পেতে দিন চলে। রাত কাটে গাছ তলায়। এ বাড়ি ও বাড়ীর বারান্দায়। সখিপুর পাহাড়ের আদিবাসীদেরবলে মান্দাই। এরকম এক কৃপাশীল মান্দাই আশ্রয় দেয় পাগলাকে। শুধু আশ্রয় নয়, পাগলের জন্য দয়ামায়াও উতলে উঠে তার। কিন্তু পাগল পাগলই। মাঝে মাঝে সে মান্দাইয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে। মারপিট করতে যায়, গালি গালাজ করে, এটা সেটা ভেঙ্গে অনর্থের সৃষ্টি করে। মন ভাল থাকলে আবার বাড়ির কাজেও লাগে। একদিন পাগলের মন ভাল। মান্দাইয়ের জমিতে তখন বীজ বুনার সময়। প্রয়োজনীয় বীজ মেপে পাগলার কাঁধে চাপিয়ে দেয় ক্ষেতে বুনার জন্য। পাঁচ বিঘা জমির মধ্যে সোয়াসের ধান ছিটিয়ে পাগলা চলে এল বাড়ী। মান্দাই অবাক। পাগলকে জিজ্ঞাস করতেই ক্ষেপে গেল সে। মান্দাইকে বলে দিল ঠিক ১০ দিন পর ক্ষেত দেখতে যাবি। তার আগে গেলে ভূমিতে এক ফোটা ধানও হবে না। সরল হৃদয়ের মান্দাই দশ দিন পর গিয়ে দেখে সতেজ চারায় পরিপূর্ণ তার ক্ষেত। কোথাও ফাঁক নেই। সেবার তার ফসল ফলেছিল অন্যান্য বারের দ্বিগুণ। তারপর থেকেই মান্দাইয়ের ভক্তি বাড়ে পাগলের উপর। একবার এক গোখরো সাপ ছোবল মারে মান্দাইয়ের ছেলেকে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। ওঝা পাওয়া গেল না। খবর পেয়ে ছুটে আসে পাগলা। মুখের থুথু ঘষে দেয় দংশিত স্থানে। চোখ মেলে তাকায় মান্দাইয়ের পুত্র। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ সে। লোকজন হতবাক। রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে এ সংবাদ। বিখ্যাত হয়ে উঠে ফাইলা পাগলা। ঝড়-ঝঞ্ঝার, বন্যা-খরা, দুর্ভিক্ষ মহামারির ভবিষ্যৎ বাণীও করত সে। অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেত তার কথা। যে পাগল ছিল সকলের অবহেলার পাত্র, এই সব অলৌকিক গুণে সকল অবহেলা শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে রূপ নেয়। সৃষ্টি হয় এক বিশাল ভক্ত বাহিনীর।
পাগলা মারা গেলে কবরস্থ করা নিয়ে শিষ্যদের মাঝে বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয়। আত্মীয়রা চায়, পাগলার নিজ গ্রাম বাসাইলের দেউলীতে, আর ভক্তরা চায় দাড়িয়াপুর পাহাড়ে সমাধিস্থ করতে। শেষ পর্যন্ত ভক্তদের অনুরোধে দাড়িয়াপুরে তাকে সমাহিত করা হয়। পশ্চিমে গিলাবাড়ি গ্রাম। গ্রামের উত্তর পূর্ব প্রান্তে বংশাই নদী। নদী পার হয়ে লাল মাটি পেরিয়ে পূর্ব দিকে কিছুদূর অগ্রসর হলেই দাড়িয়াপুরের ফাইলা পাগলার মাজার পাওয়া যায়। মাজার ঘিরে তিন দিন ব্যাপী শুরু হয় জাকজমকপূর্ণ মেলা, হাজার হাজার ভক্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসে এই মেলায়। ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করে মাজারে। শ্রদ্ধাভরে তারা স্মরণ করে ফাইলা পাগলার কথা। লৌকিক এবং পরলৌকিক মঙ্গলের আশায় নিবেদন করে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস